ফসলের লাভজনক ফলন এবং তার গুণাগুণ শুধু উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে না। সাথে সাথে সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ এবং সংগ্রহ প্রনালীর ওপরও তা অনেকটা নির্ভর করে। ফসল সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফলকে উৎপাদন পর্যায় হতে ব্যবহারিক পর্যায় আনা হয় । যত্নের সাথে এ কাজের তদারকি এবং সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহের ফলে আমরা পাই আর্থিক মূল্য সম্পন্ন গুণগতমানের ফসল এবং এর বর্ধিত খাদ্য উপাদান । ফল অক্ষত অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষনের জন্য এবং উৎকৃষ্ট মানের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য দ্রব্য তৈরি করার জন্য ফসল যথা সময়ে সতর্কতার সাথে সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের লক্ষ্য অনুযায়ী ফসল যখন নিজ নিজ জাতের সর্বোৎকৃষ্ণ আকার, রং, স্বাদ এবং গুণাগুণ অর্জন করে । তখনই ফসল সংগ্রহ করা উচিত। অপরিপক্ক ফল সংগ্রহ করলে যেমন গুণাগুণ বজায় থাকে না তেমনি চাষী ফলের ন্যায্য মূল্য পায়না। আবার বেশি পরিপক্ক হলেও গুনগত মান তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে ফল দ্রুত পচায় । ফলে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফলের পরিপক্কতা এমন একটি অবস্থা যখন ফলের আকার ও আয়তন এবং বয়সের সর্বশেষ অবস্থা, অর্থাৎ এরপর ফলের আকার ও আয়তন আর বৃদ্ধি পায় না । ফল পাকার অর্থ হলো পরিপকৃতার পর ফলের গুণাগুণের এমন পরিবর্তন, যার মাধ্যমে ফল ভক্ষণযাগ্য বা খাবার উপযোগী হয় । ফল পাকার সাথে সাথে ফলের রং, গন্ধ ও বুনটের পরিবর্তন হয় যার দরুণ ফল ভোক্তার নিকট গ্রহণযোগ্য হয় ।
ফলের পরিপক্বতা
ফলের পরিপক্বতা এমন একটি অবস্থা যখন ফল আকার, আয়তন এবং বয়সে সর্বশেষ অবস্থায় পৌছে অর্থাৎ এর পর ফল আর আকার ও আয়তনে বৃদ্ধি পায় না। কিছু লক্ষণ দেখে ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা যায় । এই লক্ষণগুলো কে ফলের পরিপকৃতার লক্ষণ বা (Maturity Index) বলা হয়। ফল ধারণ থেকে দিবস সংখ্যা, আকার, আকৃতি, রং, বুনট, আপেক্ষিক ঘনত্বের পরিমাণ, দ্রবণীয় শক্ত পদার্থ, চিনি, অম্লে হার এবং চর্বির পরিমান ইত্যাদি পরিপক্বতার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নতি করা হয় । ফল সংগ্রহের পূর্বে ফলের পরিপক্বতা দেখে সংগ্রহ করা উচিত। ফল সংগ্রহের সময়ের ওপর নির্ভর করে ফলের বাহ্যিক সতেজতা, ফলের স্বাদ, গুণাগুণ, গন্ধ ও আকার ইত্যাদি । ফল বর্ধনের তিনটি ধাপ । বিদ্যমান । যেমন:
১। বাড়ন্ত (ফুল হতে গুটি ধারণ করে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত)
২। পরিপক্কতা (ফল উপযুক্ত হওয়ার পর সংগ্রহ করার পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত) এবং
৩। পরিপক্কতার পর পেকে উঠা বা ফিজিওলোজিক্যাল ম্যাচুরিটি ।
ফল তালোর জন্য ফলের পরিপক্কতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা । কারন ফল পাকা অবস্থাতেই খাওয়ার উপযুক্ত হয় । উদাহরণ- কলা, জাম, আনারস, পেয়ারা, বেল, পিচ, আংগুর, লিচু ইত্যাদি, একমাত্র পরিপক্ক অবস্থাতেই খাওয়া যায় ।
ফলের মধ্যে এমন অনেক ফল আছে যে গুলোর শ্বসন, কাজ ফল ভালোর পর বন্ধ হয়ে যায় । শ্বসন কাজ বন্ধ হওয়ার ফলে তার মধ্যে সঞ্চিত শর্করা বা শ্বেতসার থেকে চিনিতে রূপান্তর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। যেমন- আংগুর, লেবু, জাম্বুরা, লিচু, ইত্যাদি।
আবার ফলের মধ্যে এমন অনেক ফল আছে যেগুলোর শ্বসন কাজ ফল তালার পরও চলতে থাকে। এমনকি ফলের পরিপক্কতার সাথে সাথে শ্বসন কাজ বাড়তে থাকে এবং ফলের মধ্যে সঞ্চিত শর্করা বা শ্বেতসার চিনিতে রূপান্তরিত হতে থাকে । যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে বেল, কামরাঙ্গা, আমড়া, ইত্যাদি । তাই এ জাতীয় ফল পরিপক্ক অবস্থা হতে খাওয়ার উপযোগী বা উপযুক্ত হওয়ার সময়ের মধ্যে পাড়তে হবে। এরপর পরিবহন ও বাজারজাতকরণের কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে।
ফলের পরিপক্বতা এমন একটি অবস্থা যখন ফল, আকার, আয়তন, রং এবং বয়সের সর্বশেষ অবস্থায় পৌঁছে এবং তারপর আর আকার ও আয়তনে বাড়ে না । বিভিন্ন লক্ষণ দেখে ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা হয় । বিশেষ অবস্থায় ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য । যেমন -
ক) বাড়ন্তবস্থায় ফল রোগাক্রান্ত হলে অপরিপক্ক অবস্থায় পরিপক্ক ফলের মত রং ধারণ করে ।
খ) জমিতে রস ও পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকলে অপরিণত বয়সের ফল পরিপক্ক দেখায় ।
গ) জমিতে রসের ও পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকলে এবং তাপমাত্রা কমে গেলে ফলের পরিপক্বতা বিলম্ব হয় ।
ঘ) পোকা মাকড়ের আক্রমণ হলে ফল অপরিণত বয়সে পেকে যায়
ঙ) হঠাৎ অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ায় পরিণত বয়সেও ফল পরিপক্ক হয় না ।
ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা যায় দু'ভাবে যথা-
১। বাহ্যিক অবস্থা দেখে ও
২। অভ্যন্তররীণ পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে
১ । বাহ্যিক অবস্থা - ফল ধারণ থেকে দিনের হিসাব, ফলের আকার ও আকৃতি, ফলের রং, ফলের ওজন, ফল শক্ত বা নরম, ফলের ত্বকের গন্ধ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে ।
২। অভ্যন্তররীণ - শর্করা বা শ্বেত সারের পরিমান, মিষ্টতার পরিমাণ, ফলের কষ বা রসের ঘনত্ব, বীজের পরিপুষ্টতা, ভক্ষণযোগ্য অংশের ঘনত্ব (শক্ত বা নরম অবস্থা), আঁশের পরিমাণ, আশের দৃঢ়তা ও স্পষ্টতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষন করে ।
ফল সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি:
মানুষের শরীর সুস্থ, সবল ও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে ফলের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ । ফলের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সঠিক সময়ে গাছ থেকে ফল পাড়া অতীব জরুরি ।
ফলের ভালো ফলন এবং তার গুণাগুণ শুধু উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে না । সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ করার ওপরও ফলের গুণাগুণ এবং লাভ নির্ভর করে । অনেক সময় অনেক বেশি মূল্যে বিক্রির জন্য কাঁচা ফলই বাজারে উঠায় । এটা মোটেই উচিত নয় । মাঝে মাঝে কাঁচা ফলকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাকা রঙ ধারন করায়ে বাজারে বিক্রয় করে । এতে অনেকে প্রতারিত হয় । লোকে জানাজানি হলে এ ধরনের ফল আর ক্রয় করতে চায় না । এতে উৎপাদক, বিক্রেতা, দেশে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় । তাই ফল এমন অবস্থায় পড়তে হবে যাতে পাড়ার পর অতি অল্প সময়ে পাকে এবং কেউ প্রতারিত না হয় ।
ফল তরতাজা রাখার জন্য সংগ্রহের সময় বিশেষ যত্নবান হতে হবে । সংগ্রহের সময় ফল ক্ষতিগ্রত বা আঘাত প্রাপ্ত হলে বাজার মূল্য ও পুষ্টিমাণ কমে যায় । অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে আর্থিক ক্ষতি হবে । তবে ফলের মান বজায় রাখার জন্য পরিপুষ্ট অবস্থায় ফল সগ্রহ করা উচিত । ফল সংগ্রহের জন্য কিছু উপকরণের প্রয়োজন হয়, যেমন- কাঁচি, ছুরি, মই, রশি, ব্যাগ, ধারালো দা ইত্যাদি । ফল সংগ্রহের প্রাককালে নিম্নোক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় রাখতে হবে যেমন-
ক) ফলের পরিপক্বতার উপযুক্ত বয়সে সগ্রহ করতে হবে ।
খ) পরিষ্কার আবহাওয়ার সময় ফল পাড়তে হবে ।
গ) ফল পাড়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ফল আঘাত না পায় বা থেতলে না যায় ।
ঘ) সাবধানতার সাথে ফলগুলো এক জায়গায় জড়ো করতে হবে ।
ঙ) ফল জড়ো করার স্থানটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ছায়াযুক্ত হতে হবে ।
চ) ফল পাড়ার জন্য ব্যবহৃত উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ভালভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে ।
সাধারণত দু'ভাবে ফল সংগ্রহ করা যায় । যথা-
১ । হাত দিয়ে তোলা বা পাড়া এবং
২। মেশিনের সাহায্য পাড়া
১ । হাত দিয়ে তোলা বা পাড়া- উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই বেশির ভাগ ফল সতেজ অবস্থায় বিক্রির জন্য হাত দিয়ে পাড়া হয় । হাত দিয়ে ফল পাড়ার কতগুলো সুবিধা আছে । যেমন
হাত দিয়ে পাড়ার অসুবিধাগুলোঃ
২। মেশিনের সাহায্যে ফল পাড়া ও হাত দিয়ে ফল পাড়া বেশি পছন্দনীয় হলেও অনেক সময় মেশিনের সাহায্য ফল সংগ্রহ করতে হয় । মেশিনের সাহায্যে ফল সংগ্রহের কতগুলো সুবিধা আছে ।
যেমন সুবিধাগুলো
মেশিনে ফল পাড়ার অসুবিধাগুলো
ফল পাড়ার সময় বা ছিড়ার সময় যে সব ফল আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে পাড়া উচিত । যে সব ফল হাতের নাগালের মধ্যে থাকে না সে গুলো গাছে উঠে অথবা জালি বাঁধা বাশের লাঠির সাহায্যে পাড়া উচিত । তাতে লাঠির মাথার জালির মধ্যে করে আস্তে আস্তে ফল পাড়া যায়। আবার লাঠির মাথায় ছুরি বা কাচি বেধে বোটা কেটে ফল পাড়া যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফল যে পাড়তে উঠে তার কাঁধে থলে বা ঝুড়ি ঝুলায়ে রাখলে সুবিধাজনক হয় ।
ফল পাড়ার আগে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে যে ফল কি উদ্দেশ্য পাড়া হচ্ছে। কেননা আচার বা টক জাতীয় খাদ দ্রব্য হিসেবে ফল সংরক্ষণ করতে হলে অপরিপক্ক অবস্থায় অনেক সময় ফল পাড়তে হয়। অন্যদিকে জুস জাতীয় খাদ্য দ্রব্য তৈরি করতে হলে বেশি পাকানোর প্রয়োজন হয় । ফল টাটকা অবস্থায় দূরে পাঠাতে হলে সম্পূর্ণ পরিপুষ্ট অবস্থায় পড়তে হয়। অনেক সময় বেশি দুরে পাঠাতে হলে ফল পাকার ৪-৫ দিন আগেও পাড়তে হয় । ফল পরিপুষ্ট হলে বিভিন্ন ফলের জাত বিশেষে সর্বোৎকৃষ্ট আকার রং, স্বাদ গন্ধ এবং গুণাগুণ অর্জন করে । আর তা ক্রেতার নিকট সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য হয়। ফল পাড়ার পূর্বে বিবেচ্য বিষয় বা গাছ থেকে ফল পাড়ার সর্তকতা :
১। পুষ্টতা সঠিকভাবে নির্ধারণে করে ফল পাড়ার কাজ শুরু করতে হবে । কারণ অপুষ্ট ফল পাড়লে তা ঠিকমত পাকে না এবং স্বাদ, রং, সুবাস ইত্যাদির ঠিকমতো উন্নয়ন ঘটে না ।
২ । ফলের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফল সংগ্রহের কাজে শ্রমিকরা সতর্কতা ও দক্ষতার সাথে কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া গাছে ঝাঁকি দিয়ে ফল পাড়া ঠিক নয় ।
৩। গাছ মোচড়ানো, ফল মাটিতে ফেলে দেয়া, ফলের গায়ে আঘাত দেয়া, ফলের গায়ে মাটি লাগানো, সংগৃহীত ফলে সূর্যের তাপ লাগানো পরিহার করতে হবে ।
৪ । ফল বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় ।
৫। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর দীর্ঘক্ষন তা গাছের নিচে জমা করে রাখা ঠিক নয়। কারণ বাতাসে ভাসমান রোগের জীবাণু এ সময় আমের বোটায় আক্রমণ করার সুযোগ পায় ও বোটা পচা রোগের সৃষ্টি করে ।
৬ । সকাল বেলা ফল পাড়া ভালো, কারণ তখন আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে বৃষ্টি বাদলার দিনে ফল পাড়া পরিহার করতে হয়।
৭। কিছু বেটাসহ ফল সংগ্রহ করা ভালো । আমের ক্ষেত্রে ৩-৪ সে:মি: বোটাসহ আম পাড়তে পারলে বোটা পচা রোগের প্রকোপ অনেক কমে যায়। অবশ্য গাছ ছোট হলে এ কাজ সহজ হয়।
৮ । ফল পাড়ার জন্য সব সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। ছোট গাছের ফল পাড়ার জন্য সিকেচার ব্যবহার করা সুবিধাজনক ।
৯ । প্রত্যেক ফলের বোটায় একটি নরম জায়গা থাকে, সেখানে চাপ দিলে বোঁটা সহজেই ভেঙে যায় ।
১০ । আম পাড়ার পর কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখা ভালো, এতে ফলের আঠা আমের গায়ে লাগতে পারে না ।
ফল বাছাইকরণ
ফল গাছ হতে সংগ্রহ করা সব ফল একই মান ও আকার সম্পন্ন হয় না । একই জাত অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ফল আকার আকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের হয় । এদের মাঝে আবার কতগুলো রোগাক্রান্ত বা পোকায় খাওয়া হতে পারে । উলিখিত সব ধরনের ফল মিশ্রিত অবস্থায় বাজারজাত করার পূর্বে ফলকে বাছাই বা শ্রেণিভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । আকার আকৃতি ও অন্যান্ন গুণাগুণ বিবেচনায় বাজারজাত করা হলে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ফলের দাম নির্ধারন সহজতর হয় । এতে করে ক্রেতা তার পছন্দ মত ফল ক্রয় করে সন্তুষ্টি হতে পারে। ফলের উৎপাদিত অঞ্চল হতে দূরবর্তী কোন অঞ্চলে প্রেরণের উদ্দেশ্য থাকলে ফলের পরিপক্কতার মাত্রানুযায়ী বাছাই করে পৃথক পৃথক বাক্সে পাঠানো প্রয়োজন । এতে ফল নস্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে ।
ফল সংগ্রহকালীন সময় হতে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কমবেশী ফল বাছাই সম্পন্ন হয় ।
পরিপক্ব হওয়ার পর একই গাছ হতে সংগ্রহ করা ফল একইরকম গুণ সম্পন্ন হয় না । কেননা একই গাছের সব ফল এক সাথে বড় হয় না এবং একই আকৃতির হয় না। একই সাথে পরিপুস্ট হয় না এবং একই সাথে পাকেও না । এমন কি পাকার সময় একই ধরনের রংও ধারণ করে না। একই গাছের বা একই জাতভুক্ত গাছের ফল কতগুলো রোগাক্রান্ত, পোকায় খাওয়া বা শারিরিকভাবে বিকৃত হতে পারে । এমন কি একই গাছে ফুল ও ফল হওয়ার সময় যে অংশ রোদ বা আলো বাতাস বেশি পায় সে অংশের ফলের মধ্যে একধরনের পরিবর্তন দেখা দেয় । আবার গাছের ভেতরের দিকের বা ডালপালার ছায়ায় যে সব ফল হয় সেগুলোর মধ্যে অন্য ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। গাছের যে অংশে রোদ ও আলাবাতাস বেশি পায় সে অংশের ফল সাধারণত রোদ পোড়া, উজ্জ্বল রং বা ফলের ত্বকে ফোটা ফোটা তিলের মত দাগ ইত্যাদি পাওয়া যায়। এ ফল গুলো আগে পাকে এবং বেশি মিস্টি হয়। গাছের ভিতরে বা ছায়ায় যে ফলগুলো হয় সেগুলো সাধারণত আকারে বড় হয়, ফল ও জাত বিশেষ রং সবুজ বা কোমল হয় এবং মিষ্টতা কম হয় ।
পাড়ার পর সমত ফল একত্রে মিশানো অবস্থায় না রেখে বড়, ছোট, রোগাক্রান্ত বা পোকায় খাওয়া, অপরিপক্ক, শারীরিক ভাবে বিকৃত, রং ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে বাছাই করে শ্রেণি বিভক্ত করা উচিত । তাছাড়া ভালো ফলের আকর্ষণীয়তা ফুটে উঠেনা। ফল দেখতে সুন্দর না হলে তা দাম দিতে আগ্রহী হয় না। তাই ফল জারে পাঠানোর আগে বাছাই করে শ্রেণি বিভক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । খারাপ ফলগুলোকে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা যেতে পারে। ফল বাছাই করনের সময় উ”চমান সম্পন্ন ফলের সাথে নিম্ন ৫-১০ মিশ্রণ গ্রহণযোগ্য বলে ধরা যেতে পারে। সাধারনত আকার, আকৃতি, রং, পরিপক্কতার মাত্রা, রোগাক্রান্ত, পোকা খাওয়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ফল বাছাই করা হয়ে থাকে। খারাপ ফলগুলোকে ফলজাত দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা । যেতে পারে। ফল বাছাই দু'ভাবে করা যায় । যথা-
ক) হাতের সাহায্যে এবং
খ) মেশিনের সাহায্যে
ক) হাতের সাহায্যে ফল বাছাই করতে হলে ফল হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফলের আকার নির্ণয় করা হয় । চোখে দেখে ফলের আকার ও রং অনুমান করে শ্রেণি বিভক্ত করা হয় । অনেক সময় হাতে নিয়ে ফলের ওজন নির্ণয় করা হয় । ফল শক্ত কেমন তা হাতে ধরে অনুমান করা হয় । তবে এ কাজটি ফল ভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে । গাছ হতে পাড়ার পর সব ফল একই রকম পাওয়া যায় না। কোনটি হালকা হলুদ, কোনটি গাঢ় সবুজ, কোনটি বড়, কোনটি ছোট, কোনটি খুব শক্ত এবং ওজন বেশি আবার কোনটি তেমন শক্ত নয় এবং ওজনে হালকা, কোনটি রোগ ও পোকা মাকড়ে আক্রান্ত কোনটি পাড়ার সময় আঘাত প্রাপ্ত বা থেতলানা, আবার কোনটি সুস্থ ও সতেজ, কোনটি মিষ্টি ঘ্রান যুক্ত, আবার কোনটির কোন ঘ্রান নাই ইত্যাদি । হাতের সাহায্যে ফল বাছাই করলে বাছাই কাজটি অনেকাংশেই নিখুত ও ভালো হয় ।
খ) মেশিনের সাহার্যে বাছাই করতে হলে ফল বাছাইয়ের আকৃতি নির্ধারণী রিং ব্যবহার করা হয় । ফল ভেদে বিভিন্ন মাপের নির্ধারণী রিং হতে পারে। যেমন- ৬০, ৬৪, ৭০, ৭৫, ৮০, ৮৫ সে:মি: সাইজের রিং, মেশিনে ফল বাছাই ও গ্রেডিং সহজে এবং দ্রুত করা যায়। কিন্তু কোন ফল থেতলানো বা রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত থাকলে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে হাতে আলাদা করে নিতে হয় । এমনকি ফলের গায়ে ময়লা থাকলে তা হাত দিয়ে আলাদা করে নিতে হয় । মেশিনে বাছাই করা ফল কনভেয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন আকারের প্যাকিং বাক্সে স্থানান্তরিত হয়, যা আগে হতে নির্ধারণ করা থাকে ।
ফল বাছাইকরণের সুবিধা
১। বিভিন্ন আকারের ফল আলাদা আলাদা করা থাকে, তাই দাম নির্ধারণ করা সহজ হয় ।
২ । আঘাতপ্রাপ্ত, রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল আলাদা আলাদা থাকে, তাই ফল নষ্ট হয় না ।
৩ । ফল বাছাই করার জন্য শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয় ।
৪ । বিভিন্ন আকারের ফল বিভিন্ন প্যাকিং বাক্সে সর্বোচ্চ সংখ্যায় সাজানো হয় ।
৫। প্যাকিং-এর জন্য ব্যবহৃত প্যাকেজের সংখ্যা দেখে ফলের সংখ্যা নিরূপণ করা হয় ।
৬। ফল বাছাই করনের মাধ্যমে ফলের মান নির্ণয় করা সহজ হয় ।
৭ । ফলের আকার এবং পরিপকৃতার ওপর নির্ভর করে সিধান্ত গ্রহণ করা যায় যে তা দূরে পাঠানো যাবে কিনা । কেননা বড় ফলের সাথে ছোট ফল একত্রে থাকলে বড় ফলের চাপে ছোট ফল নস্ট হতে পারে ।
ফল বাছাইকরণে সতর্কতা বা ফল বাছাইয়ের পূর্বে বিবেচ্য বিষয়
১ । ফল বাছাই করনের স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর, ঠান্ডা, ছায়াযুক্ত ও যথেষ্ট বাতাস চলাচল সম্পন্ন হতে হবে।
২। ফল বাছাইকরণের সময় ভাল ফলের সাথে আঘাত প্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত বা পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল একত্রে রাখলে নষ্ট ফল দ্রুত পঁচে তা ভালো ফলকে নষ্ট করতে পারে। ভালো ফল এবং নষ্ট ফল পৃথক পৃথক রাখতে হবে ।
৩। বাছাই করার সময় ফল একজায়গা হতে অন্য জায়গায় ছুড়ে না ফেলে আস্তে আস্তে রাখতে হবে ।
৪ । বাছাই করার সময় নিচে চট বা নরম জিনিস বিছায়ে নিয়ে তার উপর ফল নাড়াচাড়া করা উচিত । তাতে ফল কম আঘাত পাবে ।
৫ । যতদূর সম্ভব কম সংখ্যক ফল একত্রে স্তূপ করা উচিত । কেননা বেশি উঁচু করে ফলের স্তূপ করা হলে চাপে নিচের ফল নষ্ট হতে পাবে ।
৬। বাছাই করার সময় উচ্চমান সম্পন্ন ফলের সাথে নিম্নমানের ফলের ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি যেন মিশ্রণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ফলের আকার অনুযায়ী গ্রেডিং
বাছাই এর পর ফলের আকার ও মান অনুযায়ী ফল শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে । কারন ভালো আকার ও ভালো মানের ফল বেশি অর্থায়নে সাহায্য করে। বৃহৎ ও উৎকৃষ্টতর গুণসম্পন্ন ফল পায় সর্বদাই ক্ষুদ্র ও নিকৃষ্ট ফল অপেক্ষা অধিক অর্থ আনায়ন করে থাকে । সর্ব আকারের ও প্রকারের ফলকে একই সঙ্গে না রেখে ও গুলোকে আকার ও গুণ অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে নিলে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের পক্ষেই সঠিক মূল্য নির্ধারণে সুবিধা হয় এবং তাতে কারোরই ঠকবার সম্ভাবনা থাকে না । সুতরাং বিক্রয়ের জন্য ফল বাক্সবন্দী করা অথবা স্থানান্তরিত করনের পূর্বেই সেগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে নেওয়া উত্তম। একই বস্তা, ঝুড়ি বা বাক্সের নীচে ছোট এবং উপরে প্রদর্শনের জন্য বড় আকারের ফল রাখার প্রথাটি একান্তভাবে বর্জনীয় ফলকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট মানে বিভক্ত করন (Standardization) একটি উত্তম পদ্ধতি ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। একমাত্র পরিপক্ক অবস্থাতেই খাওয়া যায় এমন তিনটি ফলের নাম লেখ ।
২। অপরিণত বয়সের ফল পরিপক্ক দেখায় কি কারণে?
৩। বেল ফুল ধরা হতে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত কত দিন লাগে ?
৪ । উচ্চমান এবং নিম্নমান সম্পন্ন ফলের মিশ্রণ কত ভাগ পর্যন্ত গ্রহণ যোগ্য ?
৫ । বাজারে সাধারনত কোন কোন মাপের ফল গ্রেডিং নির্ধারণী রিং পাওয়া যায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল বাছাইকরণে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় লেখ।
২ । ফলের পরিপকৃতার লক্ষণ কাকে বলে ?
৩। ফলের পরিপক্কতার ও পাকার মধ্যে পার্থক্য কী ?
৪ । গ্রেডিং কেন করা হয় ?
৫ । ফল বাছাইকরণের সুবিধাগুলো লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল বর্ধনের ধাপ গুলো কি কি এবং কোন কোন অবস্থায় ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা হয় লেখ ।
২ । ফল সংগ্রহ, বাছাই ও বাজারজাতকরণ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
৩ । ফল কিভাবে সংগ্রহ করা যায় এবং ফল সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধা আলোচনা কর ।
৪ । ফলের পরিপক্বতা কিভাবে নিরূপণ করা যায় ? আম, কাঁঠাল ও পেয়ারার পরিপক্কতা পদ্ধতি বর্ণনা কর ।
৫। বোর্দো মিকচারের প্রস্তুত প্রনালি বর্ণনা কর ।
Read more